আপনি যদি এই পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই লক্ষ্য করেছেন যে, আমার লেখার একদম উপরের প্যারাতে বলেছিলাম, কোটিপতি হওয়ার জন্য টাকা কামানোটা হচ্ছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু টাকা কামানোর চাইতে আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে টাকা জমানো বা সঞ্চয় করা। আর টাকা সঞ্চয় করার চাইতে আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঞ্চয়কৃত টাকা সঠিক রাস্তার ইনভেস্টমেন্ট করা।
আপনার জমানো টাকা আলমারিতে রেখে দিলে সেই টাকা বাড়বে না, বরংচ কমবে। আজ আপনার আলমারিতে এক লক্ষ টাকা থাকলে এক বছর পর সেই টাকার মান এক লক্ষ টাকা থাকবে না। কারণ ২০২০ সালে যে জিনিস এক লক্ষ টাকা দিয়ে কিনতে পারবেন, ২০২১ সালে সেই জিনিস এক লক্ষ টাকা দিয়ে ক্রয় করতে পারবেন না।
স্বাভাবিক নিয়মে সময়ের সাথে সাথে প্রত্যেকটি জিনিসের দাম বৃদ্ধি পায়। সাধারণত প্রত্যেকটি ছোট, বড় ও মাঝারি জিনেসের প্রতি বছরে প্রায় ৬% করে দাম বৃদ্ধি পায়। সেই হিসেবে আপনার কাছে ১০০ টাকা থাকলে এক বছর সেই টাকার মূল্য তখন হবে ৯৪ টাকা।
অর্থাৎ যে জিনিস আপনি ১০০ টাকায় কিনতে পারতেন, এক বছর পর সেই জিনিস কেনার জন্য আপনাকে ১০৬ টাকা ব্যয় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপনার কাছে এ লক্ষ টাকা থাকলে, এক বছর পর সেই টাকার মূল্য হবে ৯৪ হাজার টাকা। অথচ আপনি বুঝতেই পারেননি যে, আপানার আলমারিতে থাকা এক লক্ষ টাকা হতে এক বছরে ৬ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।
এখন হয়ত ভাবছেন, তাহলে আমাকে কি করতে হবে? আপনার কাছে থাকা জমানো টাকা কিভাবে ইনভেস্ট করবেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে কিভাবে আপনি টাকা সঞ্চয় করবেন, সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক। কারণ টাকা না থাকলে, টাকা ইনভেস্টমেন্ট করার প্রশ্নই আসে না। কাজেই আগে আপনাকে টাকা সঞ্চয় করতে হবে।
কিভাবে টাকা সঞ্চয় করবো?
কিভাবে টাকা সঞ্চয় করতে হবে, সে বিষয়ে উপরে ১০ টি পয়েন্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আপনি যদি উপরের সবগুলো বিষয় ভালোভাবে অনুসরণ করতে পারেন, তাহলে টাকা সঞ্চয় করা আপনার কাছে কোন বিষয় হবে না। তারপরও আপনি কিভাবে একদম প্রাইমারি লেভেল থেকে টাকা সঞ্চয় করা শুরু করবেন, সেটাও আমরা দেখবো।
পৃথিবীর সব কোটিপতিদের জীবন বৃত্তান্ত পড়লে দেখা যায় শুরুতেই কেউ বড়লোক বা কোটিপতি ছিল না। অধিকাংশ কোটিপতিরা তাদের আয়ের একটি অংশ সঞ্চয় করার মাধ্যমে সঞ্চয়কৃত টাকা সঠিক রাস্তার ইনভেস্টমেন্ট করার মাধ্যমে ধিরে ধিরে কোটিপতি হয়েছেন। টাকা জমানোর বিষয়ে একটি উদাহরনের মাধ্যমে বিষয়টি আমি আরো ক্লিয়ার করার চেষ্টা করছি।
উদাহরণ– একসময় এক রাজা ছিল। সেই রাজার খুব বিশ্বস্ত এক দুষ্ট মন্ত্রী ছিল। কিন্তু রাজা তার দুষ্টমির বিষয়ে কিছু জানতেন না। দুষ্ট মন্ত্রীর প্রতি রাজার আন্তরিকতা দেখে রাজ্যের অন্যান্য সকল মন্ত্রীবর্গ এবং প্রজারা খুব হিংসা করত। যার জন্য একদিন সাবাই মিলে সেই দুষ্ট মন্ত্রীকে বিপদে ফেলে। রাজা তার মন্ত্রীর খারাপ কাজ শুনে খুব রাগ করেন এবং বিশ্বাস ঘাতকতা করার দায়ে থাকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন।
মন্ত্রীর মৃত্যুদন্ডের আদেশ কার্য্যকর করার দিন রাজা তার মন্ত্রীকে বলেন, তুমি আমার খুব বিশ্বস্ত মন্ত্রী ছিলে, তোমার কোন শেষ ইচ্ছা থাকলে আমাকে বলতে পার। আমি তোমার শেষ ইচ্ছা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। তখন মন্ত্রী বলেন, আমার পরিবারের ভরপোষন করার জন্য প্রতিদিন ১ টাকা করে দিতে হবে এবং সেই টাকার উপরে ডাবল সুদ দিতে হবে। অর্থাৎ প্রতিদিনের ১ টাকা ও পরের দিন ১ টাকা + আগের দিনের ১ টাকার সুদ সহ মোট ৩ টাকা। এভাবে চক্রহারে সুদ দিতে হবে।
রাজা বিষয়টি বুঝতে না পেরে মন্ত্রীর শেষ ইচ্ছা পুরনের আশ্বাস দেন। কিন্তু এভাবে চক্রহারে সুদ বাড়তে বাড়তে কয়েক বছর পর রাজা নিশ্ব হয়ে যান। রাজার যত টাকা ছিল সব টাকা পয়সা প্রয়াত মন্ত্রীর পরিবারকে দিতে দিতে একসময় রাজার সহায় সম্বল বিক্রি করে দিতে হয়।
এই উদাহনের পিছনের আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, বিন্দু বিন্দু বালুকনা মিলে মরুভূমি তৈরি হয় বা ছোট ছোট পানির ফুটা থেকে সাগর সৃষ্টি হয়। আপনি যে পেশায় থাকুন না কেন, আপনার আয়ের কিছু অংশ মাসে মাসে কিংবা সন্তাহে বা প্রতিদিন সঞ্চয় করে রাখলে এক দুই বছর পরে সঞ্চয়ের টাকার পরিমান বিশাল অংকের হয়ে উঠবে।
আপনি কি পরিমান সঞ্চয় করবেন, সেটা আপনার আয়ের উপর নির্ভর করবেন। আপনার মোট আয়ের ৫-১০% জমা করে রাখলে মাত্র কয়েক বছরে আপনার বিশাল অংকের টাকা জমা হবে। আপনার যদি টাকার প্রয়োজন কম থাকে, তাহলে আপনার প্রয়োজনানুসারে সঞ্চয়ের পরিমান আরো বৃদ্ধি করতে পারেন। এতেকরে আপনার বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দ্রুত পুরন হবে।
কিভাবে টাকা ইনভেস্টমেন্ট করবেন?
কথায় কথায় অনেকে বলে টাকা থাকলে মাথার ব্রেইন খুলে যায়। আসলে কথাটা একদম খারাপ নয়। আপনার কাছে টাকা থাকলে আয় করার উপায় আপনি নিজে নিজে খুঁজে নিতে পারবেন। আপনার কাছে টাকা থাকলে আপনাকে পথ দেখানোর লোকের অভাব হবে না। তারপরও কিছু সংখ্যক লোক আছে যাদের টাকা থাকা সত্বেও বছরের পর বছর আলমারি টাকা রেখে টাকা নষ্ট করছে।
যখন আপনার কাছে টাকা থাকবে তখন আপনার প্রয়োজনের বিষয় বিবেচনা করে বা আপনি কোনটি করতে পারবেন, সেটি বিবেচনা করে আপনাকে ঠিক করতে হবে, আপনার সঞ্চয়কৃত টাকা কোথায় ইনভেস্ট করবেন। কারণ সঠিক ইনভেস্ট ছাড়া লোকসানে পড়লে আপনার জমানো টাকা হারাতে পারেন। কাজেই কোথায় ইনভেস্ট করবেন, সেটা আপনাকে ভেবে চিন্তে ঠিক করে নিতে হবে। নিচের কয়েকটি কাজে আপনার টাকা ইনভেস্ট করতে পারেন।
ক্ষুদ্র ব্যবসা করা
আপনার কাছে ব্যবসা করার মত সুযোগ থাকলে, আপনি অবশ্যই সঞ্চয়কৃত টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করবেন। আপনার কাছে টাকা কম থাকলে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করতে পারেন। সকল সফল ব্যবসায়িরা শুরুর দিকে ছোট ব্যবসা করে এবং কালক্রমে সফল হওয়ার পর ব্যবসা সম্প্রসারিত করে। একমাত্র ব্যবসা হচ্ছে এমন একটি লাভজনক কাজ, যেটির মাধ্যমে অল্প সময়ে বড়লোক হওয়া সম্ভব।
কি ব্যবসা করবেন, সেটা আপনার অভীজ্ঞতা ও আপনার এলাকার উপর ডিপেন্ড করবে। আপনার স্থানীয় এলকায় যে ব্যবসা লাভজনক মনেহবে সেই ব্যবসা শুরু করতে পারেন। শুরুর দিকে কিছুটা কঠিন মনে হলেও ধিরে ধিরে ব্যবসা সম্পর্কে আপনার অভীজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যবসার আয় বৃদ্ধি করার পথ নিজেই খুঁজে নিতে সক্ষম হবেন।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বুদ্ধিই হলো মূল মূলধন। কেননা চিন্তা ভাবনা না করে বোকার মত ভুল জায়গায় বিনিয়োগ করলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে, এইটাই স্বাভাবিক।
তাই কোথায় কোন ব্যবসায় ইনভেস্ট করলে লভ্যাংশের কিছু অংশ আপনার অ্যাকাউন্টে জমা হবে সে ব্যাপারে নিজেকে তৈরি করে নিন। নিজের বুদ্ধি এবং জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ইনভেস্ট করার চেষ্টা করুন এবং এমন স্থানে করুন যাতে আপনাকে লসের মুখে পরতে না হয়।
বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকে FD ও বীমা করা
আপনি যদি মনেকরেন যে, আপনি একজন প্রফেশনাল লোক বা ব্যস্ত লোক, আপনার দ্বারা ব্যবসা করা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে আপনি বিভিন্ন ব্যাংকে এফডি (Fixed Deposit) করতে পারেন।
সেই সাথে আপনার ও আপনার পরিবারের সদস্যদের নামে ইন্সুরেন্স করে নিতে পারেন। বিশেষকরে চাকরিজীবিদের জন্য হেল্থ ইন্সুরেন্স করাটা খুব জরুরী।
তাছাড়া ছেলে মেয়েদের জন্য শিক্ষা বীমা করে নেওয়াটা ভালো। এ সব বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনেকরি না। কারণ এগুলো বিষয়ে আমরা সবাই কম বেশি জানি। কাজেই আপনার কাছে টাকা থাকলে সেগুলো আলমারিতে না রেখে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডি (Fixed Deposit) ও বীমা করতে পারেন।
৩। মিউচুয়াল ফ্যান্ড
মিউচুয়াল ফ্যান্ড থেকে টাকা কামানো অনেক লাভ জনক একটি সোর্স। মিউচুয়াল ফ্যান্ড অনেকটা শেয়ার মার্কেট এর মত কাজ করে। আপনি শেয়ার মার্কেট বা স্টক সম্পর্কে অভীজ্ঞতা সম্পন্ন হলে মিউচুয়াল ফ্যান্ডে টাকা জমা করার প্রয়োজন নেই।
এ ক্ষেত্রে আপনি সরাসরি শেয়ার মার্কেটে কাজ করে রাতারাতি কোটিপতি হতে পারবেন। তবে এ বিষয়ে আপনার পূর্ণাঙ্গ অভীজ্ঞতা না থাকলে হিতের বিপরীত হতে পারে। কাজেই শেয়ার মার্কেটে কাজ করতে চাইলে আগে শেয়ার ও স্টক সম্পর্কে অভীজ্ঞতা অর্জন করে নিবেন।
কিন্তু আমাদের মত যারা চাকরিজীবি বা সাধারণ মানুষ আছে তাদের জন্য শেয়ার মার্কেটে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে আপনি মিউচুয়াল ফ্যান্ডে টাকা জমা রাখতে পারেন। অনেকে মিউচুয়াল ফ্যান্ড বিষয়টি না বুঝতে পারেন। কারণ বাংলাদেশে এটি খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। ভারতে মিউচুয়াল ফ্যান্ড বেশ জনপ্রিয়।
মিউচুয়াল ফ্যান্ড কি?
মিউচুয়াল ফ্যান্ড অনেকটা ব্যাংকের মত কাজ করে। তবে এখানে আপনাকে কিছুটা ঝুকি নিতে হয়। ভালোমানের মিউচুয়াল ফ্যান্ড কোম্পানিতে টাকা রাখলে লোকসানের সম্ভাবনা খুবই কম থাকে।
মিউচুয়াল ফ্যান্ড মূলত শেয়ার মার্কেটের কাজ করে। আপনার আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তারা শেয়ার মার্কেটে শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে টাকা আয় করে এবং লভ্যাংশের কিছু টাকা আমাদের দেয়।
এখানে তারা যেটা করে সেটা হচ্ছে, তাদের কোম্পানিতে শেয়ার মার্কেটের বিষয়ে অনেক অভীজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ লোক থাকে।
তারা সবসময় শেয়ার মার্কেটিং নিয়ে রিসার্চ করে। কোন্ মার্কেটে কাজ করলে লাভবান হওয়া যাবে সেটা যাচাই করে তারা টাকা ইনভেস্ট করে। এ ধরনের কোম্পানিতে টাকা ইনভেস্ট করে প্রচুর পরিমানে টাকা আয় করা সম্ভব হয়।